শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন কতটা যৌক্তিক ?
সানা হাসান
বেশ কিছুদিন ধরেই সপ্তাহের প্রতি রোববার ৩ ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করছেন বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের দাবি, সম্প্রতি প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে শিক্ষকদের প্রতি বেতন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় তাঁদের বেতন একধাপ নীচে নামানো হয়েছে। দাবি অনুযায়ী, এই কাঠামোর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অমর্যাদা করা হয়েছে। তাই অষ্টম বেতন স্কেলে শিক্ষকদের বেতন ভাতা পুন:নির্ধারণসহ আনুষঙ্গিক মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে কোমড় বেঁধে নেমেছেন আমাদের শিক্ষকরা।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে সপ্তাহের প্রতি রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত কর্ম বিরতি পালন করছেন । এসময়ে ক্লাস, পরীক্ষাসহ কোন একাডেমিক কাজই করছেন না তারা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতি পালন করে আসলেও এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি। মেলেনি সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাড়াও। এরই প্রেক্ষিত, গত রোববার নতুন করে কর্মসূচী দেয়াসহ দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর আন্দোলনে যাবার হুমকি দিয়েছেন তারা।
এবার আসি আমার মূল আলোচনায়। আমাদের শিক্ষকরা প্রায়ই দাবি করে থাকেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের বেতন কম। এমনকি এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায়ও পিছিয়ে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যান ও হালচিত্র অনুযায়ী, শিক্ষদের বর্তমান দাবি ও আলোচনাগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দ্রব্যমূ্ল্যের বাড়তি বাজারে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেমন করে দিনাতিপাত করেন তা শুনে এবং বুঝে যে কেউই আঁতকে উঠতে পারেন। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে আন্দোলন চলছে তার ফলাফল কী? আমরা দেখছি আদৌ কোন ফলাফল নেই। এর মধ্যে দিয়ে কাদের লাভ হল ? তবে কারও লাভ না হলেও শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে তা দৃশ্যমান। কতগুলো ক্লাস, পরীক্ষা, জীবনের মূল্যবান সময় থেকে বঞ্চিত হয়েছে শিক্ষার্থীরা তা আমাদের শিক্ষকেরা ভালই জানেন বোধ করি। সেশনজটের এই আমলে যেখানে একজন শিক্ষার্থী কুঁকড়ে মরেন, ডুকরে কাঁদেন, এমন সময়েও আমাদের শিক্ষকরা তাদের প্রিয় ছাত্রদের চোখে জল দেখেই সুখ পান কিনা আমার জানা নেই। তা না হলে আন্দোলনের প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারত বলেই বোধ করি।
ধরি, সরকার আমাদের শিক্ষকদের দাবি মেনে নিল না। শিক্ষকরাও ওনাদের দাবিতে লৌহদন্ডের ন্যায় অনড় থাকলেন। তখন কি হবে? তখনও কি এভাবেই আন্দোলন চলতে থাকবে। নাকি বন্ধ করে দেবেন চলমান আন্দোলন। নাকি নিয়ে আসবেন আরও ভয়াবহ কোন আন্দোলন। ওনাদের হুমকি তো ভয়াবহতারই ইঙ্গিত দেয়। যদি এমনটিই হয়, তবে কি এভাবেই শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ঝরে যাবে মূল্যবান সময়গুলো? শিক্ষকরা ওনাদের স্বার্থের জন্য কোন দয়া দক্ষিণা দেখাবেন না প্রিয় ছাত্রদের। সেশনজট সহ নানা কারণে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একরকমের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারওপর শিক্ষদের এমন আন্দোলন শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা ভাবাও আতঙ্কের। । তাই বলছি, ছাত্রদের এমন করুণ দশা দেখে কি আঙুল চুষবেন শিক্ষকরা? তাহলে তো বেশ ভালো। কিছুই বলার নাই।
এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে শুধু একটি কথাই বলার আছে। স্যার, ছাত্ররা কিন্তু আপনাদেরকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। আপনাদের প্রতিটি যৌক্তিক আন্দোলনেই শিক্ষার্থীদের সমর্থন থাকে, আছে। আপনাদের দাবির প্রেক্ষিতে পূর্বের আন্দোলন গুলোতেও ছাত্রদের ভূমিকাই তার উজ্জ্বল উদাহরণ হতে পারে।
স্যার, ছাত্ররা আপনাদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। বাস্তবায়ন চায়। সেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কেমন করে কষ্ট দিচ্ছেন আপনারা? একটু্ও কি আপনাদের হৃদয় কাঁদে না? একটু্ও কি আপনাদেরকে ভাবায় না? এক সময়তো আপনারাও আমাদের মতো ছাত্র ছিলেন। আজ আপনারা যদি আমাদের জায়গায় থাকতেন তবে কি করতেন। সেই জায়গা থেকে একটু বিবেচনা করে দেখবেন কি?
আমাদের শিক্ষকরা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন কাঠামো নির্ধারণের কথা বলছেন। বেশ। কথায় কথায় বলেন, ওনারা যদি অন্য চাকুরীতে থাকতেন কত ভাল থাকতেন। কত ভাল বেতন পেতেন। অনেকে এও বলেন, কত দামী চাকুরী ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। এমন কথাগুলো কতটা যৌক্তিক? অন্যান্য জায়গায় এত ভাল থাকলে এখানে আসার কি কোন যৌক্তিকতা আছে? উনারা কি সরকারের বা বেসরকারি কিংবা উন্নয়ন সংস্থার অন্যান্য কর্তাদের ন্যায় দায়িত্ব পালন করেন ?? উনাদের দায়িত্বের জন্য কোথাও কি জবাবদিহি করতে হয় ? না করতে হয় না, করেনও না। সরকারের কর্মকর্তারা (তুলনামূলকভাবে কম), বেসরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্বের প্রতি যতটা সচেতন আমাদের স্যারেরা কি ততটা সচেতন? এক কথায় তার উত্তর হবে না।
আমাদের শিক্ষকদের কোথাও কোন জবাবদিহি নেই। ক্লাস নিলে ও নেই, না নিলেও নেই। নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস না নিয়ে ইচ্ছেমত সময়েও ক্লাস নেন কেউ কেউ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাতা দেখলেও জবাবাদিহি নেই, না দেখলেও নেই। পরীক্ষার ফলাফলের জন্য কত শিক্ষার্থীর কত অপেক্ষায় থাকে। সেখানে ও একই হিসাব। কখন পরীক্ষা দিল, কখন ফলাফল দিবে তা শিক্ষকদের মর্জির উপর র্নির্ভর করে। সম্ভবত, অনেক সময় তা শিক্ষকদের খেয়ালই থাকে না। কারণ, ওনারা অনেক ব্যস্ত। হাতে আছে বিশাল এক অস্ত্র। ওনারা শিক্ষক। ওনাদের আছে ৭৩’র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ। এই আইন অবাধ স্বাধীনতাই দিয়েছেন শিক্ষকদের। তাই কথায় কথায় ৭৩’র অধ্যাদেশের বুলি আওড়ান। হুমকি দেন কোন কিছু না করার।
অনেক শিক্ষকই আছেন দিনের পর দিন ক্লাস নেন না। বিদেশে গিয়ে আসেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে বিদেশে পড়তে যান, আসার কোন খবর থাকে না। বিশববিদ্যালয় থেকে নোটিশ পাঠিয়েও ওনাদের লেজুরটি ধরতে পারেন না। ওনারা থাকেন সপ্তাকাশে। তাই এখানে উনাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য সব শিক্ষক যে এমন নন । তবে বেশিভাগ শিক্ষকই যে এমন তা বললে ভুল হবে বলে বোধ করি না।
এদিকে সম্প্রতিকালে যোগ হয়েছে শিক্ষকদের আরেক খেলা। ওনারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যান। ওখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পান। তাই ওখানে খেটে পড়ান। কিন্তু, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নয় ছয় করে বুঝিয়ে যান। কারণ, এখানে এমন করলে জবাবদিহির বালাই নেই। এত সব কিছুর পরও আমোদের স্যারেরা মনে করেন, উনারা ঠিক। যা করেন, যা বলেন, যে সিদ্ধান্ত নেন সবই যৌক্তিক।
যাই হোক, এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আমাদের শিক্ষকদের নারী প্রীতি, স্বজন-প্রীতি নতুন নয়। ওনারাদের সাধ্যমত তা করে যান। অনেক স্যারের বিরুদ্ধেই ছাত্রীর সাথে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ আসে। অনেকেই ছাত্রীদেরকে কুপ্রস্তাব দেন। এর বিনিময়ে পরীক্ষার খাতাসহ অন্যান্য জায়গায় সুবিধা দেয়ার লোভ দেখান। অনেক মেয়েরাই এতে পটে যান। নিয়মিত শিক্ষকের সাথে কুকর্মটি করে নানান সুবিধা হাতিয়ে নেয়। এদের মধ্যে দু একটি ছাত্রী শিক্ষকদের এমন কর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান। দাঁড়িয়ে ও লাভ নেই। কারণ, স্যারেরা অনেক ক্ষমতাবান। ওনাদের কিছুই হয় না। তাই চুপসে যায়। না হয় শিক্ষকের প্রস্তাবে মাথা পেতে নেয়। শিক্ষকরা হচ্ছেন হীরক রাজা। সুতরাং ওনাদের সম্পর্কে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। ( বি:দ্র: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক জনাব শাহাব উদ্দীন নীপুর ফেসবুক স্ট্যাটাস,৩০ আগষ্ট ২০১৫ এমনটিই সাক্ষী দেয়।)
আমার কথাগুলো অনেকেই মেনে নেবেন। অনেকেই নেবেন না। তবে অধমের কথাগুলো একেবারেই অযৌক্তিক বলে ফেলে দেবেন না। সম্মানিত শিক্ষকদের বলছি, স্যার আপনাদের প্রতি আমাদের কোন বিরুদ্ধাচারণ নেই। শ্রদ্ধার কমতি নেই। তাই দয়াকরে ,আপনারা এমন কোন আন্দোলন করবেন না যাতে অধম, দুর্ভাগা শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়। শিক্ষার্থীরা বড়ই অসহায় । তাদের কোন আশ্রয়স্থল নেই। দাবি জানানোর আর কোন জায়গা নেই। আরেকটি কথা,অধমের উপরের আলোচনাগুলোরও যৌক্তিক বিবেচনা করার অনুরোধ করছি।
লেখকঃ শিক্ষার্থী
৪র্থ বর্ষ, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই
প্রতিক্ষণ/এডি/এনজে